Result52

অভিজ্ঞতা বর্ণনা : একদিন ভাওয়াইয়া গানের আসরে

একদিন ভাওয়াইয়া গানের আসরে

একদিন ভাওয়াইয়া গানের আসরে

ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গ তথা রংপুর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় গান । এই গানের ওপর গবেষণা করতেন আমার ছোটো চাচা । নানান স্থান থেকে একটি মাইক্রো ক্যাসেটে করে তিনি গানগুলো সংগ্রহ করে আনতেন, আর সাথে তার ক্যামেরায় গায়কের ছবি থাকতো । তখন অবশ্য আজকের মতো মোবাইল ফোনের এত প্রচলন ছিল না, তাই চাচা অনেক কষ্টে একবার গায়কের কাছে ক্যাসেট ধরতেন, আবার তার ছবি উঠাতেন । একদিন চাচা বললেন— চল আমার সঙ্গে । চাচা কোনো কিছু বললে আমি সচরাচর না করতে পারি না । তাই শুধু বললাম হুঁ । চাচার সঙ্গে চললাম নীলফামারীর উদ্দেশে । প্রথম পৌঁছলাম রংপুর; এরপর বাসে জলঢাকা তারপর তিস্তা ব্যারেজ পার হয়ে সোজা নীলফামারীর ডোমারে । এখানে বাসে আসতে আসতে আমার শরীরের প্রায় ১২টা বেজে গেছে । চাচা জিজ্ঞাসা করে কীরে খারাপ লাগছে নাকি? ততক্ষণ একটু সোজা হয়ে সপ্রতিভ হয়ে বলি, ‘না' । তিনি অবশ্য আমার অসুবিধা বুঝতে পেরেছেন । তাই ডোমারে নেমেই একটা খাবার হোটেলে নিয়ে গেলেন । সেখানে হাত-মুখ ধুয়ে বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত খেলাম । শরীর মন যেন জুড়িয়ে গেল । সেই সকালে তাড়াহুড়ো করে ভাত খেতে পারিনি। সত্যি ভাত ছাড়া আমার আর অন্যকিছু তেমন পছন্দ নয় । চাচা এবার একটা রিকশা নিয়ে বললেন, ‘চল’ । কিন্তু কোথায় যাচ্ছি ভেবে পাচ্ছিলাম না । ডোমার একটি ছোটো শহর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা গ্রামে ঢুকলাম । অবশ্য, পাকা রাস্তা দিয়ে একটু যেতেই দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন । চাচাকে দেখেই বললেন, ‘কীরে খুব কষ্ট হয়েছে বুঝি?’

আমি অবাক হলাম, উনি আবার কে? চাচা রিকশা থেকে নেমেই আমাকে পরিচয় করে দিলেন— ‘ও শাওন- আমার ভাইয়ের ছেলে । ভদ্রমহিলা বেশ আদর করে আমার হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে গেলেন । পরে বুঝলাম উনি চাচার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী । উনি আমাদের নাস্তা কী করাবেন, তা নিয়ে যখন ব্যতিব্যস্ত হলেন, তখন চাচা বললেন— 'না, প্রয়োজন নেই— একেবারে হোটেল থেকে ভাত খেয়ে এসেছি । রাতে খাব । খাবার কথা শুনে তিনি বললেন- 'সে কী...।' রাতে চাচা ভালো করে বোঝালেন, আসলে আমার কাজটি কী হবে? তিনি বললেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত শিল্পীর গান নেব না । আমরা একেবারে গ্রামের অশিক্ষিত-দরিদ্র শিল্পীর গান সংগ্রহ করব।' আর এক্ষেত্রে আমাকে সুন্দরভাবে গান পরিবেশন অবস্থায় ক্যামেরায় ছবি উঠাতে হবে । মূলত ছবি উঠানোই আমার কাজ । পরের দিন সকালে দুচার জন শিল্পী এসে হাজির । কীভাবে যেন খবর পেয়েছেন— আমরা এ কাজে এসেছি । কিন্তু চাচা বললেন— 'আমি আপনাদের গান শুনব কিন্তু পরে ।' আমরা পায়ে হেঁটে এক গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলাম— দুই-একজনকে চাচা ভাওয়াইয়ার গায়ক সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন । পরে জানলাম মতিয়ার নামে একজন গায়ক আছে । তবে এ গ্রামে নয় ঐ গ্রামে । কী আর করার । আমরা চললাম । পেছন থেকে একজন ডেকে বললেন, ‘এ্যাটে তো মতিয়্যার' । দেখলাম এখানকার অন্যতম ফসল আদার খেতে নিড়ানির কাজ করছে । পরনে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মালকোঁচা মেরে পড়েছে । আমাদের দেখামাত্রই মালকোঁচটা খুলে সালাম দিলেন । গান জানে কি-না- প্রশ্নে প্রথমেই তিনি না করলেন । কিন্তু ততক্ষণে গ্রামের আর প্রায় দশ-বারো জন এসে উপস্থিত । তারাই বরং বললো ‘ওমাক গান শুন্যাবু ন্যা কেন?' অগত্যা তিনি বাড়ি থেকে দোতারা নিয়ে আসলেন । আদার খেতে যে ‘ড্যারা' অর্থাৎ পাহারা দেওয়া ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দোতলার ঘর— সেখানেই বসল গানের আসর । দোতারার মনোমুগ্ধকর সুরে আরও লোকজন এসে উপস্থিত হলো । গান শুরু হলো— ‘আজি ধিকো ধিকো ঐ মইষাল ধিকো তোমার হিয়া, কোন পরানে যাইবেন মইষাল মোকে ছাড়িয়া...' এ অঞ্চলের জনপ্রিয় মইষালী ভাওয়াইয়া গান । এরপর গাইলেন—

নোদীও না যান বইদো—
ঐনা নদীর ঘোলারে ঘোলা পানি
মুই নারী তুলিয়্যা দেইম পানি -

নারীর অপরিসীম আকুতিতে ভরপুর সকল গান । এ গানে যেন আবহমান বাংলার প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় । বিকেলের শেষে আসর ভাঙল; আমরা ফিরতে চাচ্ছি । কিন্তু গায়ক মতিয়ার বললো, তার বাড়িতে যেতে হবে । চাচা যখন বললো, ‘আজ সময় নেই' । তিনি তখন বললেন— ‘তাইল্যা মোর গান মোক ফিরি দ্যাও।' অর্থাৎ সে নাছোড়বান্দা । আমরা তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা খড়ের ঘর, একপাশে বাঁশের বাতারি দিয়ে তৈরি মাচা; ঘরের দরজাটিও বাঁশের তবে আধাভাঙা; বেড়াগুলো অর্ধেক নষ্ট হয়েছে । মেঝেতে এক ছেঁড়া মাদুরে বসলাম— মতিয়ারের বউ এক গামলা ভর্তি ভাত আর মোরগের মাংস নিয়ে হাজির হলেন । এতক্ষণে বুঝলাম, এজন্যই মতিয়ারের এত আপত্তি । কোনো ধরনের সংকোচ না করেই মতিয়ারের বউ আমাদের খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন । এক পরম তৃপ্তিতে যেন খেলাম ।

শুধু অনুভব করলাম এ গায়করা অন্য ধরনের মানুষ । তাদের গলায় স্রষ্টা যেমন সুর দিয়েছেন তেমনি ওদের মনও। চাচা শুধু বললেন— ‘দেখেছিস, লোকশিল্পীদের হৃদয় কত বড়ো!' এরপর ফেরার পালা ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আজকের আইডিয়ার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url
Result52
Result52
Result52
Result52